কাচ সমুদ্রঃ মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত এক নারীর কাহিনী

গল্পটি রিয়াজ ও তার মায়ের । লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবাল। উচ্চ শিক্ষালাভের জন্য সে আমেরিকা যায়।তার গাড়ি কেনার শখ।তাই সামার ভ্যাকেশনে  চাকরির সন্ধানে একটা কোম্পানিতে ইন্টারভিউ দিতে আসে।এখানে এসে তার পরিচয় হয় বব কার্ডওয়েল ও ক্রিস্টিনাসহ আরও অনেকের সাথে।

এই বর্ব কার্ডওয়েল বেশ রসিকতার মানুষ। তবে রসিকতার সাথে ব্যাঙ্গ করার অভ্যাসও আছে।রিয়াজের চওড়া ওল্ডফ্যাশন্ড টাই দেখে সে ব্যাঙ্গ করতে ছাড় দেয় না।তবে বাস্তবতাকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলে,” যখন কেউ ইন্টারভিউ দিতে আসে তখন কি সুন্দর সেজেগুজে আসে কিন্তু জয়েন করার পরেই ছেড়া জিন্স।আর যারা তোমাদের বয়সী তাদের কথা তো ছেড়েই দাও,তারা যেকোনো মতে তাদের মূল্যবান পাছাটাকে ঢেকে আসে সেটাই যেন আমাদের কপাল।”

ববের মাধ্যমে ক্রিস্টিনার সাথে পরিচয় হয় রিয়াজের। উপন্যাসের পুরোটা জুড়েই আমরা ক্রিস্টিনা আর রিয়াজের উপস্থিতি পাবো।ক্রিস্টিনা কোম্পানির সিস্টেম অ্যাডমিনিস্ট্রেটর। সে আমেরিকান মেয়ে। বাড়াবাড়ি সুন্দরী নয় তবে কমবয়সী এবং রূপ-সচেতন।কিছুদিনের মধ্যে রিয়াজ আর ক্রিস্টিনার মধ্যে বিচিত্র এবং ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। লেখক যেটাকে বলেছেন,

 ” অত্যন্ত ঘনিষ্ট একটা সম্পর্ক যেটা সহজেই ভালোবাসা হতে পারতো কিন্তু কখনোই পরিপূর্ণ ভালোবাসা হবে না”।

কেন হবে না! তার কারণ পরের কাহিনী পড়লে জানতে পারবেন।

রিয়াজ থাকতো নিউইয়র্ক কিন্তু কোম্পানিটি ছিল নিউজার্সিতে। বেশ দূরের পথ।  নিউজার্সিতে বাসাভাড়া খরচেই বেতন শেষ হয়ে যাবে ভেবে  সে বাসা নিতে চায় না।কিন্তু রাস্তায় অনেক জ্যাম থাকায় সে পরে বাসা নিতে আগ্রহী হয়।ক্রিস্টিনাকে সাথে নিয়ে সে বাসা খুজতে বের হয়। কিন্তু ভালো বাসা না পেয়ে ফিরে আসে।

কিছু দিন পর ক্রিস্টিনা জানায় সে এক মাসের জন্য ভ্রমণে যাবে। সঙ্গী একজন পুরুষ। নাম জেফ। ইনকাম ট্যাক্স এটর্নি।

সে রিয়াজকে একমাস তার অ্যাপার্টমেন্টে থাকার জন্য বলে।রিয়াজ রাজি হয়।তবে সে একমাস একজন পুরুষের সাথে থাকবে শুনে রিয়াজ মনে মনে ব্যথা পায়।কিসের ব্যথা সেটা সহজেই অনুমেয়।

একসপ্তাহ পার হতে না হতেই হঠাৎ ক্রিস্টিনা ফিরে আসে।তার চোখে মুখে ক্ষত।আঘাতের চিহ্ন। রিয়াজ এগিয়ে এসে জানতে চায় কি হয়েছে।ক্রিস্টানে রিয়াজকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দেয় এবং সব ঘটনা বলে।জেফ এর সাথে তার ঝগড়া হয় এবং জেফ তাকে মারপিট করে। এজন্য তার এই অবস্থা।

এ ঘটনার পর রিয়াজ আর ক্রিস্টিনা আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে যায়।অফিসের সবাই এটা জানতো।একদিন ক্রিস্টিনা রিয়াজকে বলে তাকে তার সন্তানের বাবা হতে। কিন্তু রিয়াজ রাজি হয় না।সে বলে সন্তান নিলে সেও বাবা হিসেবে দায়িত্ব নিতে চায়। কিন্তু মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বে তাদের মিলন হয় না।

লেখকের ভাষায়,

ক্রিস্টিনা কোনো কথা না বলে কিছুক্ষণ রিয়াজের দিকে তাকিয়ে রইল। তার মুখ একটু গম্ভীর হয়ে আসে এবং তাকে হঠাৎ একজন অপরিচিত মানুষের মতো দেখাতে থাকে। ক্রিস্টিনা একটা বড় নিশ্বাস নিয়ে বলল, “না, তোমাকে আমি প্রস্তাব দিচ্ছি না। তবে?”

“তবে?”

“তোমাকে আমি অন্য একটা প্রস্তাব দিতে পারি।”

রিয়াজ হঠাৎ কেন জানি বিপন্ন অনুভব করে, সে দুর্বল গলায় বলল, “কী প্রস্তাব?”

“আমি সবসময় একটা ফ্যামিলি চেয়েছিলাম। পাইনি। তুমি যদি রাজি থাকো” ক্রিস্টিনা একটা বড় নিশ্বাস ফেলে বলল, “তাহলে তুমি কি আমার একটা সন্তানের বাবা হবে?”

কথাটির অর্থ বুঝতে রিয়াজের কয়েক মুহূর্ত লেগে গেল। সে অবাক হয়ে বলল, “তুমি কী বললে?”

“বলেছি যে আমি একটা বাচ্চা চাই। আমার নিজের বাচ্চা। তুমি কি তার বাবা হবে?”

“বাবা?”

“হ্যা। তোমার কোন দায়দায়িত্ব থাকবে না। বাচ্চাটাকে আমি বড় করব, মানুষ করব। তুমি যদি না চাও তাহলে তাকে কোনোদিন বলব না কে তার বাবা। তুমি শুধু আমাকে তেইশটি ক্রমোজম দেবে।”

“তেইশটি ক্রমোজম? আমি?”

“হ্যাঁ। তোমাকে যেটুকু দেখেছি মনে হয়েছে বেশ ভালোমানুষ আমি চাই আমার সন্তানের বাবা হোক একজন ভালোমানুষ।

রিয়াজ চোখ বড় বড় করে ক্রিস্টিনার দিকে তাকিয়ে রইল। এখনো সে তার কথা পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছে না। ক্রিস্টিনা মুখে একধরনের করুণ আবেদনের ভঙ্গি করে বলল, “রাজি?”

রিয়াজ মাথা নেড়ে বলল, “এটা তুমি কী বলছ?”

রিয়াজের কথায় ক্রিস্টিনার আশাভঙ্গ হল। সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নিচু করে বলল, “তুমি তাহলে রাজি নও।” “না। ক্রিস্টিনা তুমি বুঝতে পারছ না এটা একটি অন্যায় অনুরোধ। এই অনুরোধে রাজি হওয়া যায় না।”

“কেন?”

“আমি যদি একটি বাচ্চার জন্ম দিতে চাই তাহলে তার দায়িত্বটাও নিতে চাই। আমার সন্তানকে আমি দেখব না শুনব না, সেটা তো হতে পারে না। আমি তো স্পার্ম ব্যাংক না।”

ক্রিস্টিনা মিনতি করে বলল, “প্লিজ।”

“এটা হয় না ক্রিস্টিনা।”

“কেন হয় না? আমি-আমি তোমার একটা সন্তান চাইছিলাম।”

“কেন? আমার কেন?”

“কারণ, কারণ, তোমাকে আমার খুব পছন্দ রিয়াজ।”

রিয়াজ একটা নিশ্বাস ফেলে হাত বাড়িয়ে ক্রিস্টিনার হাত ধরে বলল, আমাকে মাফ কর ক্রিস্টিনা। এটা হয় না।”

এ ঘটনার পরও তারা বন্ধু হিসেবে থাকে।

এরপর কাহিনী দারুণভাবে  মোড় নেয়। রিয়াজ তার পরিবার সম্পর্কে ক্রিস্টিনাকে বলতো মাঝে মাঝে। রিয়াজের সৎ বোন একদিন চিঠি পাঠায় বাবার অসুস্থতার কথা বলে।

অন্য একটা চিঠিতে জানায় যে তার প্রকৃত মা মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকবাহিনীর  শ্লীলতাহানির স্বীকার হয় এবং অন্তসত্ত্বা হয়ে পড়ে। যুদ্ধ শেষে ফিরে এলে তার বাবা রিয়াজের মাকে বাড়ি নিতে অস্বীকৃতি জানায়। পরে নরওয়ের এক মহিলা পুনর্বাসন কেন্দ্র তার মাকে পুনর্বাসনের দায়িত্ব নেয়।

তার মায়ের এমন কষ্টের কাহিনী রিয়াজকে দারুণভাবে ব্যথিত করে। সে তার বাবাকে ধিক্কার দিতে থাকে এহেন নিষ্টুরতার জন্য।

লেখকের ভাষায়,

-“তুমি যেটা বলেছ সেটা একটা অবিশ্বাস্য নিষ্ঠুরতার ঘটনা”।(ক্রিস্টিনা)

-“কোন অংশটি বেশি নিষ্ঠুর ক্রিস্টিনা? পাকিস্তানের মেজরের অংশটি নাকি আমার বাবার অংশটি?”(রিয়াজ)

এখানেই তার মায়ের প্রতি বর্বরতার কঠিন দিকটি ফুটে ওঠে।

ক্রিস্টিনার সহায়তায় রিয়াজ পরে তার মা মিসেস জাহানকে  খুঁজে পায় ক্যালিফোর্নিয়ার প্যাসাডিনা শহরে। কিন্তু দীর্ঘ দিনের কষ্ট আর ক্ষোভে সে নিজের সন্তানের পরিচয় দিতেও অস্বীকৃতি জানায়।

রিয়াজ আর ক্রিস্টিনার মধ্যে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ে উঠলেও সব ছাপিয়ে বড় হয়ে ওঠে ১৯৭১ এ মুক্তিযুদ্ধে অত্যাচারীত,নিপীড়িত, সম্ভ্রম ও পরিবার হারানো এক নারীর মর্মবেদনার দৃশ্যপট।

এখানেই উপন্যাসটি অনন্য।

About Nazrul Islam

Check Also

Temperature Structure of the Atmosphere

In general, the air is cooler at higher altitudes. Most incoming solar radiation passes through …