—-লিওনার্দো দা ভিঞ্চি।
শিল্প-সাহিত্যে সমৃদ্ধ একটা দেশকে যদি প্রথম সারির দিকে রাখা যায়, সেটা ফ্রান্স।
সেই আইফেল টাওয়ারের (ফরাসি-তুর দেফেল) দেশের সাতাশ বছরের তরুণী, যে কবিতা ভালোবাসে, শিল্পের প্রতি যার দারুণ ঝোঁক, সুন্দর, হাসিখুশি সোনালী রঙের ঝাঁকড়া চুলের ফরাসি সাহিত্যে পড়াশোনা করা মার্গারিট ম্যাতিউ।
অন্যদিকে ফরিদপুরে জন্ম নেয়া, কলকাতায় মতো শহরে বেড়ে ওঠা, কফি হাউজের আড্ডাপ্রিয়, ভ্রমণপ্রিয়, কৃত্তিবাস পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক, ত্রিশ বছর বয়সী কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।
তাদের দেখা হওয়ার কথা ছিল ফ্রান্সে, নাহলে কলকাতায়। অথচ তাদের দেখা হলো মধ্য আমেরিকার ছোটখাটো একটা জায়গায়, যেখানে একটা বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরে পুরো শহর গড়ে উঠেছে। আয়ওয়া বিশ্ববিদ্যালয়। যে শহরে রবীন্দ্রনাথের পদধূলি পড়েছে তারও অনেক আগে।
সুনীলের সাথে মার্গারিটের দেখা হওয়াটার মধ্যেই চমৎকারিত্ব লুকিয়ে রয়েছে। দুজনের মধ্যে যোগবন্ধনের মাধ্যমই ছিল শিল্প আর সাহিত্য। কবিতা ছিল যার প্রাণ।
একটা বছর হয়তো কারো জন্য অনেক কম সময়, কারো জন্য দীর্ঘ। এই এক বছরেই মার্গারিটের সাহচর্যে বিদেশে একা, নিঃসঙ্গ কবি, ফরাসি শিল্প-সাহিত্যের প্রতি আরও বিশেষভাবে আকৃষ্ট হন।
বইয়ের প্রতিটা অনুচ্ছদের শুরুতে ফ্রান্সের বিখ্যাত কবি-সাহিত্যিকদের কবিতার লাইন দেয়া। মার্গারিটের সবচেয়ে পছন্দের ছিল রেনেসার, শার্ল বোদলেয়ার, গীয়ম অ্যাপোলিনিয়ারের মতো কবি।
আছে জাঁ পল সাত্র, রুশো, ভলতেয়ার, র্যাবো,ভালেরি, আরি মিসো, এমিল জোলা, বোদলেয়ারের মতো বিখ্যাত সব কবিদের জানা-অজানা সব তথ্য।
বিখ্যাত সিগমুন্ড ফ্রয়েড ভিয়েনা থেকে এক সেমিনারে যোগ দিতে প্যারিসে আসেন, ফরাসি ভাষা রপ্ত না থাকার দরুন সেমিনারে যোগ না দিয়ে তিনি ফিরে যান ভিয়েনাতে। দু’বছর বাদে ফরাসি রপ্ত করে তিনি প্যারিসে এসেছিলেন।
এসব কবিতা, শিল্পের ফাঁকে ফাঁকে আছে ফ্রান্সের নর্মান্ডিতে জার্মানির পরাজয়ের রহস্য, ফরাসী আঠারো বছরের সাহসী তরুণী জোয়ান আর্কের কাহিনি।
রুশো আর ভলতেয়ারের দা-কুমড়া সম্পর্ক থেকে লেখা গড়িয়েছে বাঙালি দুই সাহিত্যিক বিদ্যাসাগর আর বঙ্কিমচন্দ্রের দ্বন্দ্বের দিকে। লেখকের লেখা থামে নি, বরং প্রতি অনুচ্ছেদেই নতুনভাবে বাঁক নিয়েছে।
কেউ একজন বলেছিল, প্রত্যেক শিল্পীরই দুটি মাতৃভূমি, একটি, যেখানে সে জন্মেছে, অন্যটি ফ্রান্স।
প্রতিটা লেখার মধ্যে কারো ছোঁয়া আছে, অথচ সে নেই।
হয়তো মিরাকল ঘটতে পারে। কিন্তু এখানে ঘটে নি। কুড়ি বছর পরেও তিনি ফ্রান্সের সেই লুদা গ্রামে মার্গারিটকে আনমনে খুঁজে বেড়িয়েছেন। আয়ওয়ার সেই ছোট্ট নদীর ধার দিয়ে হেঁটে স্মৃতি হাতড়িয়েছেন।
লেখক সারাবিশ্বের অনেক দেশ ঘুরেছেন; অনেক জায়গার বর্ণনা দিয়েছেন; অনেক অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেছেন। কিন্তু যেকোনো দেশে যাওয়ার পথে তার ফ্রান্সের প্রতি আত্মার টান দমিয়ে রাখতে পারেন নি।
রেনোয়া বলেছিলেন, সব যন্ত্রনাই এক সময় শেষ হয়ে যায়, কিন্তু শিল্প থাকে।