সেকেন্ড ইয়ারে বায়োলজি অলিম্পিয়াডের রিপ্রেজেনটেটিভ নির্বাচনের সময় বইয়ের প্রসঙ্গে ভাইভাতে আমাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, তোমার পছন্দের উপন্যাস কী?
দত্তা কেন আমার পছন্দের উপন্যাস সেটা হয়তো ঠিকমতো গুছিয়ে বলতে পারি নি। শরৎচন্দ্রের লেখা আমার ভালো লাগে। শুধু ভালো লাগে বললে ভুল হবে, অনেক ভালো লাগে।
কিছু উপন্যাস পড়ার পর আমার অনেকবার মনে হয়েছে, এরকম অসাধারণ লেখনী আর একটাও নাই।
কিন্তু তারমধ্যে দত্তা-ই কেন!!
শরৎচন্দ্রের লেখনীর মধ্যে আলাদা একটা ধাঁচ আছে।আজ থেকে একশ বছর আগে তিনি তার লেখনীতে যে চিন্তাভাবনার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন, এত বছর পরেও দূর্ভাগ্যবশত আমরা অনেক জায়গা থেকে বের হয়ে আসতে পারিনি।
উপন্যাসে ছোটবেলার তিনজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু বনমালী, জগদীশ এবং রাসবিহারী। যারা স্কুলে যাবার সময় প্রতিদিন প্রতিজ্ঞা করতো, কেউ কখনো বিয়ে করবে না। বড় হয়ে একটা বাড়িতে থাকবে, উকিল হয়ে টাকা জমা করে আজীবন দেশসেবা করবে।
বড় হওয়ার সাথে সাথে মানুষের স্বপ্ন বদলে যায়। জীবনের মোড় পাল্টায়। ছোটবেলায় দেয়া কথা অর্থহীন মনে হয়।
বনমালী জমিদার, জগদীশ গরীব ঘরের সন্তান, আর মাঝামাঝি অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলে রাসবিহারী। উপন্যাসের মধ্যে যতটুকু রসবোধ আছে, সেটা রাসবিহারীর চরিত্রের মধ্য দিয়ে লেখক ফুটিয়ে তুলেছেন।
বুদ্ধিমান, ধূর্ত, খল চরিত্রের রাসবিহারীর চরিত্রায়নে কয়েকটা লাইন বলা যায়।
-সত্য কথা বলার কারণে কত লোকের অপ্রিয় হই, কত লোকে গাল দেয়। কিন্তু কথা বানিয়ে বলা, ঘুরিয়ে বলা যায় কি করে? যাক বাবা, নিজের সম্পর্কে কথা বলতে আমি কোনদিনই ভালোবাসি নে- এতে আমার বড় বিতৃষ্ণা।
শুধু সম্পত্তি লাভের দিকে তার বিতৃষ্ণা কম।
পরবর্তীতে উপন্যাসের এই তিনটি চরিত্রকে ঘিরে তাদের পরের প্রজন্মের চরিত্রায়ন দেখা যায়। নরেন্দ্র, বিজয়া আর বিলাসবাবু।
শরৎচন্দ্রের লেখনীতে নারী চরিত্রের চারিত্রিক দৃঢ়তা, সাহসিকতা, দৃঢ় মনোবল আর দায়িত্ব পালনে একনিষ্ঠতার দিকটা বরাবরই ফুটে উঠে। বিজয়া চরিত্রটা সেরকমই।
আঠারো বছর বয়সী সুন্দর, বুদ্ধিমতী, ন্যায়পরায়ণ ব্রাহ্ম-মেয়ে কিভাবে দৃঢ়তার সাথে তার বাবার জমিদারি রক্ষার চেষ্টা করে; রাসবিহারীর দূরাভিসন্ধি কিভাবে এতটুকু মেয়ের কাছে ধরা পড়ে নস্যাৎ হয়ে যায়, তার দৃশ্যপট অনন্য।
অন্যদিকে জমিদারের টাকায় পড়াশুনা করা বিলাত ফেরত ডাক্তার নরেন্দ্র। সাড়ে ছয় ফুট দীর্ঘকায়, গৌর বর্ণের স্বাস্থ্যহীন নরেন্দ্র চরিত্রটি হাস্যজ্জ্বল, পরোপকারী, কথার মারপ্যাঁচ না বোঝা সহজ মনের পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর বয়সী এক যুবক।
যে ডাক্তারির পাশাপাশি গ্রামের বাচ্চা-বৃদ্ধদের জমিতে ফসল ফলানোর পদ্ধতি শেখায়।
তার বাবা জগদীশ আট বছরের জন্য জমিদারের কাছে দশ হাজার টাকা ধার নেন। ধার শোধ করতে না পারার বিনিময় মূল্য হিসেবে বাড়ি-ভিটা, সমুদয় সম্পত্তি জমা রাখেন। নরেনের পক্ষে সে টাকা শোধ করা সম্ভবও হয় না।
সেজন্য তাদের সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে, ছোটবেলার বন্ধুত্বের দাম চুকিয়ে, নিজের ছেলে বিলাসের সাথে বিজয়ার বিয়ে দিয়ে সম্পত্তি আত্মসাৎের জন্য রাসবিহারী উঠেপড়ে লাগেন।
জমিদার বনমালী বেঁচে থাকলে হয়তো উপন্যাসই সৃষ্টি হতো না। এজন্য লেখক বনমালীর সাথে বোনাস হিসেবে জগদীশকেও প্লট থেকে বের করে দিয়েছেন। ঢিশঢাশ করে কলমের কালি দিয়ে দুজনকে মেরে ফেলে লেখার মাঝে চমক নিয়ে এসেছেন।
উপন্যাসে বিয়ে নিয়ে দুটো সুন্দর লাইন আছে।
-`মনের মিলনই সত্যিকার বিবাহ। নইলে বিয়ের মন্তর বাংলা হবে কি সংস্কৃত হবে, ভট্টাচায্যিমশায় পড়াবেন কিংবা আচার্যমশাই পড়াবেন, তাতে কি আসে যায়?’
কিন্তু বিয়ে হয় দুজনের মধ্যে। এখানে প্রধান তিনটা চরিত্রের সাথে আবার একটা পার্শ্বচরিত্রও আছে। ঝামেলা।
দত্তা বলতে কারো বাগদত্তা বোঝায় কি! বিলাসের বাগদত্তা-বিজয়া কি নরেনের প্রেমে পড়ে? নাকি নরেন নলিনীকে পছন্দ করে?
নলিনী কে! কেউ কি কারো মনের কথা প্রকাশ করতে পারে? শেষপর্যন্ত বিয়ে হয় কি!
সব প্রশ্নের উত্তর জানতে চান? তাহলে পড়ুন শরৎচন্দ্রের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ এই দত্তা উপন্যাসটি।