সমুদ্রের স্বাদ: মধ্যবিত্তের জীবনযন্ত্রণার স্বরূপ

সমুদ্রের স্বাদ। উৎসঃ ইডিওগ্রাম।

অর্থনৈতিক দৈন্য মধ্যবিত্ত জীবনস্তরে জন্য এক মারাত্মক অভিশাপ। প্রাত্যহিক জীবনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বপ্ন আশা গুলো যখন দারিদ্র্যের কারণে প্রতিমুহূর্তে দলিত পিষ্ট ও চূর্ণবিচূর্ণ হতে থাকে,তখন তার স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ায় মধ্যবিত্ত হৃদয় হয়ে ওঠে আত্মকেন্দ্রিক, অপ্রতিভ, সংকুচিত ও আশাহীন বেদনায় পান্ডুর। দরিদ্র মধ্যবিত্তজীবনে বাস্তবতা ও স্বপ্নের যে দ্বন্দ্ব এবং অনিবার্যভাবে সেই দ্বন্দ্বের যে ব্যর্থ পরিণতি, সর্বোপরি এক আশাহীন পরিবেশের যে নিরবচ্ছিন্নতা- এ সবই  মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯০৮-১৯৫৬) এর ‘সমুদ্রের স্বাদ’ গল্পের মৌল উপজীব্য। গল্পটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৪৩ সনে।

এ গল্পের নীলা চরিত্রের সমুদ্র দর্শনের সাধটি এমন কোনো অসম্ভব কল্পনা নয়, তবু তা শেষ পর্যন্ত অপূর্ণ থেকে যায় – তাতেই ওই নারীর এবং সেইসূত্রে তার মধ্যবিত্তজীনের অন্তর্হিত বেদনা ও যন্ত্রণার স্বরূপ প্রকাশিত হয়ে পড়ে। শৈশবে পিতার মুখে গল্পাকারে এবং পরবর্তীকালে পাঠ্যগ্রন্থের মাধ্যমে সেই সাথে প্রতিবেশী বলাইদের বাড়িতে সমুদ্র স্নানের গল্প বর্ণনা শুনে নীলার মনে সমুদ্র দর্শনের আগ্রহ ও স্বপ্ন সুগঠিত হয়। কিন্তু স্বল্পবেতনের চাকরি, অতঃপর পিতার আকস্মিক মৃত্যু, সে কারণে মাতুলালয়ে আশ্রয়লাভ ও সবশেষে বিবাহজনিত বিশেষ পরিস্থিতি – এই সব কিছুর প্রতিকূলতায় তার সমুদ্র দেখার সাধ আর পূর্ণ  হওয়ার সুযোগ পায় না। নীলার কেরানি-পিতার স্বল্প আয়ই কন্যাকে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি ভাঙতে তাকে বারবার বাধ্য করে। স্ত্রীর দীর্ঘদিনের সাধ পূরণার্থে সমুদ্র-তীরবর্তী তীর্থস্থান পুরীতে একবার শুধু গমন, নীলার পিতার পক্ষে সম্ভব হলেও আর্থিক অনটনের কারণে সন্তানদের আকাঙ্ক্ষা অপূর্ণই থেকে যায়। ঋণ করে হলেও নীলাকে পরবর্তী পূজায় সমুদ্র দেখানো হবে- তার সেই সর্বশেষ প্রতিশ্রুতিও থেকে যায় অপালিত।

“সমুদ্র দেখাইয়া আনিবার বদলে পূজার সময় নীলাকে কাঁদাইয়া তিনি স্বর্গে চলিয়া গেলেন।”

সমুদ্রের স্বাদ বইয়ের মোড়ক। উৎস: Bengal Boi

বাবাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা নীলার একান্ত নিজস্ব জগৎটি ছিন্ন বাবারই মৃত্যুর আঘাতে। তীব্র অনুভূতিপ্রবণ নীলা সমতল ক্ষেত্র থেকে নিক্ষিপ্ত হল এক বন্ধুর ক্ষেত্রে।

সমুদ্র দর্শনের স্বপ্ন  অচরিতার্থতার পাশাপাশি নীলার আচরণে দৃঢ়মূল হয়ে ওঠে একটি প্রবণতা – কারণে প্রায়ই সে কাঁদে। এই কান্না অত্যন্ত দীর্ঘস্থায়ী হয় এবং কান্নার সমস্ত সময় জুড়ে জিহ্বার সাহায্যে সে গ্রহণ করতে থাকে চোখের জলের লবণাক্ত স্বাদ। শুধু অশ্রুবিসর্জন নয় বা স্বাদ গ্রহণ নয় রক্তের স্বাদগ্রহণ ও তার স্বভাবে পরিণত হয়।পিতার মৃত্যুর পর কলকাতার বাড়ি থেকে নীলার স্থান হলো মফঃস্বল মামার বাড়িতে। সেখানে নানা বিরূপতা, প্রতিকূলতা শিকার হওয়ার পাশাপাশি মামীদের কটূক্তিতে অতীতের স্বাচ্ছন্দ্যকে বর্তমান জীবনে খুঁজে না পাওয়ার যন্ত্রণাকাতর হৃদয়ের অভিব্যক্তি ঘটে নিষ্যন্দিত অশ্রুধারায়। অতপর বিয়ে। স্বামী সম্পর্কে নীলা কোনো তপস্যা করেনি, আশা করেনি তাই তার আশা ভঙ্গের কোনো বেদনাও নেই, যদিও তার স্বামী কুৎসিত এবং আধপাগলা কিন্তু এসব জীবনবৈশিষ্ট্য নীলার মনে কোনো হতাশা সৃষ্টি করেছে কিনা তা অনুমান করার উপায় নেই। মূলত বাস্তবের নির্মম কষাঘাতে স্বপ্ন  দেখার সামর্থ্যই সে হারিয়ে ফেলেছে- তাই তার যন্ত্রণা মারাত্মক ভয়াবহ। তার ভবিষ্যত শুধু শূন্যতায় ধূসর ও পান্ডুর। মাতুলালয় থেকে স্বামীগৃহের পরিবেশ তুলনামূলক উন্নত বলে নীলার মনঃযন্ত্রণা বৃদ্ধির বাহ্যিক কারণ অনুপস্থিত।

“তবে একটা অকথ্য হতাশার তীব্র ঝাঁঝালো স্বাদ সে অনুভব করিয়াছে এখানে। গুমরাইয়া গুমরাইয়া এই কথাটাই দিবারাত্রি মনের মধ্যে পাক খাইয়া বেরাইতেছে যে সব তার শেষ হইয়া গিয়াছে,কিছুই তার করার নাই, বলার নাই, পাওয়ার নাই, দেওয়ার নাই -শানাই বাজাইয়া একদিনে তার জীবনের সাধ, আহ্লাদ, সুখ, দুঃখ, আশা, আনন্দের সমস্ত জের মিটাইয়া দেওয়া হইয়াছে।”

সুতরাং সুযোগ পাইলে নীলা চুপি চুপি নিঃশব্দে কাঁদে। কিন্তু নীলার এই নিঃশব্দ কান্না স্বামীগৃহে স্বাভাবিকভাবে নানা জিজ্ঞাসা ও বাধার সম্মুখীন হয়। অকারণে এই কান্নার ফলে নীলা স্বামীর ধমকের শিকার হয়।

“তারপর ধমক দিয়া কয়েকবার নীলার কান্না বন্ধ করা গেল বটে, কিন্তু কিছুদিন পরে ধমকেও আর কাজ দিল না। মাঝে  মাঝে  কোনো উপলক্ষ ছাড়াই নীলা কাঁদিতে লাগিল।”

মনে হলো, তার একটা উদ্ভট ও দুর্নিবার পিপাসা আছে, নিজের নাকের জল চোখের জলের স্রোত পান না করলে তার তৃষ্ণা মেটে না। শ্বশুরবাড়িতেও দেখা যায়, কানুর মায়ের কাছে সমুদ্রে গোসলের গল্প শুনে নীলা ভেউ ভেউ করে কাঁদে।

মানিক বন্দোপাধ্যায়। উৎস: Amazon.in

মূলত,সমুদ্র জলের লবণাক্ততা সম্পর্কে নীলা অবহিত ছিল। সমুদ্র দর্শনের অপূর্ণ সাধ তার মনের সচেতন স্তরে যে দুঃখবোধের জন্ম দিয়েছে কান্না তারই বহিঃপ্রকাশ। সমুদ্রের লবণাক্ত জলের পরিবর্তে লবণাক্ত চোখের জলের স্বাদগ্রহণে সে প্ররোচিত  হয়।

বাঙালি সংসারে নারীর অবস্থান যেমন নয় সুদৃঢ়, তেমনি নয় স্বাধীন ও সার্বভৌম। পিতা কিংবা স্বামী সংসার উভয়স্থানেই তার চাওয়া পাওয়া হয় খন্ডিত। মধ্যবিত্ত সমাজেে যে বঞ্চনা অবহেলা সেটা হয় আরও অধিক। নীলা চরিত্র সেই মধ্যবিত্ত জীবনস্তরের সার্থক প্রতিনিধি- তেমনি সমুদ্র তার সার্থক প্রতিনিধি। সমুদ্রের মধ্যে যে বিশালতা গভীরতা ও অসীমের ব্যঞ্জনা, তা এই গন্ডিবদ্ধ এবং শতবন্ধন জালে আচ্ছন্ন মধ্যবিত্ত জীবনের সমান্তরালে উপস্থাপিত হওয়ার এই শেষোক্ত জীবনের ক্ষুদ্র ও সংকীর্ণ রূপটি আরও দৃঢ়ভাবে আভাসিত হতে পেরেছে। সীমাবদ্ধ জীবনকাঠামোর মধ্যে থেকে মানুষের হৃদয়ে অসীমের প্রতি যে চিরন্তন ও আনশোষিত আকর্ষণ সেটাই নীলার সমুদ্র সমুদ্র দর্শনের সাধ ও তার ব্যর্থতার ভেতর দিয়ে প্রতীকায়িত হয়েছে। রূপকের অন্তরালে জীবনের বৃহত্তর সত্য মূর্ত হওয়ার পাশাপাশি  মধ্যবিত্ত  মানুষের অপূর্ণ স্বপ্ন -আকাঙ্ক্ষার বেদনা প্রতিকায়িত হয়েছ ‘সমুদ্রের স্বাদ’ গল্পটিতে।

About Mst. Sabikun Nahar

Check Also

Temperature Contrasts: Urban and Rural

On a hot day, rural environments will feel cooler than urban environments. In rural areas, …