ট্রেন টু পাকিস্তানঃ দেশভাগ ও ধর্মীয় বিভেদের রক্তাক্ত পরিণতি

ট্রেন টু পাকিস্তান। উৎসঃ https://media.npr.org/assets/img/2017/08/11/ap_470919014_wide-2758909e2a77912cdb884a7ca67d9c206b98c72f-s1400-c100.jpg
স্বাধীনতা শব্দটা যতটা না ব্যক্তিকেন্দ্রিক কিংবা এলাকাভিত্তিক হয়, তার চেয়ে দেশভিত্তিক স্বাধীনতা বেশি তাৎপর্য বহন করে।
কিন্তু যে দেশের একটা প্রদেশের ছোট্ট একটা গ্রামে স্বাধীনতা কিংবা পরাধীনতার বিশেষ কোনো অর্থ বহন করে না, সেরকম একটা গ্রামে দেশভাগের ঠিক পরবর্তী মুহুর্তের অবস্থা কেমন হয়েছিল!

তা জানতে আমরা পিছনে ফিরে তাকাই।

আগস্ট, ১৯৪৭।
আমরা চলে যাই শতদ্রু নদীর তীরে ভারতীয় সীমান্তের পাঞ্জাব প্রদেশের `মানো মাজরা’ নামে একটা ছোটো গ্রামে; যেখানে একটা হিন্দু পরিবারসহ মুসলিম, শিখ মিলে প্রায় সত্তরটি পরিবারের বাস।

সুন্দর নদীটির মধ্যে দিয়ে রেললাইন, যা দিয়ে দিনে লাহোর থেকে দিল্লী বা দিল্লী থেকে লাহোরগামী ট্রেন দিনে দু’বার যাতায়াত করে।

যেসময় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, হত্যা, ধর্ষন আর অগ্নিসংযোগ করে প্রতিমুহূর্তেই বর্শা, তরবারি, রিভলভার আর স্টেনগান দিয়ে কচুকাটার মতো পাকিস্তানে মুসলিমরা শিখ এবং হিন্দুদের মেরে ফেলছিল।
ভারতীয়রা পাল্টা জবাবে মুসলিমদের মেরে প্রতিশোধের আগুন নিভাচ্ছিল, সেসময় মানো মাজরা এসব থেকে বহু দূরে ছিল।
এক কোটি মানুষ একদেশ থেকে আরেকদেশে শুধু নিজেদের ধর্মের কারণে ছুটাছুটি করছিল।

স্বাধীনতাকে পরিহাস করে প্রায় দশ লাখ মানুষ পারস্পরিক হত্যাকান্ডে লিপ্ত হয়েছিল।

লেখক খুশবন্ত সিং তার `ট্রেন টু পাকিস্তান’ গ্রন্থে একটা সীমান্ত মধ্যবর্তী গ্রামের মধ্য দিয়ে খুব দারুণভাবে উপন্যাসের কাহিনি ফুটিয়ে তুলেছেন। যেখানে প্রেম আর করুণার সাথে মানুষের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বীভৎসতার চিত্র নিদারুণভাবে ফুটে উঠেছে।

আমরা আবারও সেই গ্রামে ফিরে যাই।

গ্রীষ্মের দাবদাহে জ্বলতে থাকা আগস্টের এক রাতে সেই গ্রামের একমাত্র হিন্দু সর্দার, রামলাল, তার বাড়িতে মাল্লি ডাকাত কর্তৃক খুন হলে গ্রামবাসী সরব হয়ে পড়ে।
একটা খুনই যেন বাকি সব ঘটনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়ায়।

পুলিশ জুগগাত সিং নামের এক দাগী আসামীকে গ্রেফতার করে। তার সাথে খুনের রাতের পরদিন ট্রেনে করে আসা সমাজকর্মী ইকবাল সিংকেও পুলিশ হাজতে ভরে।

তারপর পড়ন্ত বেলায় বিরামহীন বয়ে চলা একটা ট্রেনকে আচমকা একদিন স্টেশনে থামতে দেখা যায়।
কোনো হুইসেল নেই।
ট্রেনের উপরেও কোনো মানুষের ছায়া নেই।

গ্রামের মানুষের ঔৎসুক্য থাকলেও ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশে তারা দূরে থেকে শুধু লাকড়ি আর কেরোসিন দিয়ে পুলিশদের সাহায্য করে।

ট্রেন টু পাকিস্তান। উৎসঃ লেখিকা।
সুদূর পাকিস্তান থেকে আগত ট্রেনে একটাও প্রাণের স্পন্দন খুঁজে পাওয়া যায় না।
শুধু গলিত, নাড়িভুঁড়ি বের হয়ে অঙ্গবিহীন শ’পনেরো নারী-পুরুষ, বাচ্চা, বৃদ্ধ লোককে মানো মাজরায় পুড়িয়ে ফেলা হয়।
গ্রামে একটা ঝুম নীরবতা নেমে আসে।
সেপ্টেম্বরের দিকে শতদ্রুর পানিও যেন দুদিনের বৃষ্টিতে ফুঁসে উঠে। সুইচ গেট পার হয়ে আসা পানি নিমিষেই বাড়তে থাকে।
রাতের অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকা হুইসেলবিহীন একটা ট্রেন থেকে আবারও একদিন খড়কুটোর মতো লাশ ভেসে আসে।
এবার তাদের না পুড়িয়ে বুলডোজার দিয়ে মাটি গর্ত করে কবর দেয়া হয়।

উত্তেজনা বাড়তে থাকে।

আশেপাশের এলাকা থেকে মুসলিমদের শরনার্থী শিবিরে সরানো হয়। মানো মাজরায় নদী পেরিয়ে চল্লিশ-পঞ্চাশজন শিখের আগমন ঘটে, যারা গুরুদুয়ারায় আশ্রয় গ্রহণ করে।
স্থানীয় মুসলিমরাও গ্রাম ছাড়ার প্রস্তুতি নিতে থাকে।

শুধু একটা মেয়ে গ্রামে থেকে যাওয়ার প্রবল আকুতি প্রকাশ করে।

সে জুগগাত সিংয়ের প্রেমিকা।
মুসলিম তাঁতীর মেয়ে নূরান। তখন তার গর্ভে জুগগাত সিংয়ের বাচ্চা।
কিন্তু পরদিন মিলিটারি ট্রাকে করে তাদের সবাইকেই চন্দননগর শিবিরে চলে যেতে হয়।
ঘরবাড়ি মাল্লি ডাকাত আর সহযোগীরা লুটপাট করে। গ্রাম শূন্যতায় ডুবে যায়।
শঙ্কায় ভরা সেই গ্রামে এক রাতে মিলিটারি জিপে করে কয়েকজন সহ আসা এক বিশ বছর বয়সী সশস্ত্র শিখ তরুণের আবির্ভাব ঘটে। যার রক্তে প্রতিশোধের আগুন টগবগ করছে।

সে মুসলিমদের উপর বদলা নিতে চায়।

চন্দননগর আর মানো মাজরার’ মুসলিমদের শতদ্রু নদীর উপর দিয়ে পাকিস্তানে যাওয়ার ট্রেনটাই তার একমাত্র লক্ষ্য।
দুটো লাশভর্তি ট্রেনের বদলে একটা লাশভর্তি ট্রেন পাকিস্তানে পাঠিয়ে বদলা নেয়ার পালা।
লম্বরদার আর শিখ মিত সিং’ এতে বাঁধা দিতে চাইলেও সহিংসতা আর প্রতিশোধের আগুনে সে চাওয়া নিস্প্রভ হয়ে পড়ে।

মাল্লি ডাকাত থেকে বহিরাগত শিখ ও গ্রামের আরও কয়েকজন সহ পঞ্চাশের বেশী লোক হত্যাকান্ডের অভিযানে অংশ নেয়ার প্রস্তুতি গ্রহণ করে।

বর্শা, দড়ি, রিভলভার জমা হতে থাকে।
ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের কানে ট্রেন হামলা পরিকল্পনার খবর আসে।
কিন্তু হাজার মানুষের ভীড়ে শুধু হাসিনা বেগম নামের একটা মেয়ের জন্যই তাকে চিন্তিত হতে দেখা যায়।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের শেষ চেষ্টা হিসেবে যিনি সমাজকর্মী ইকবাল সিং আর আসামী জুগগাত সিংকে হাজত থেকে মুক্ত করেন।

দুজনই মানো মাজরা গ্রামে ফিরে দুদিকে চলে যায়।

ইকবাল গুরুদুয়ারায় ফিরে পুরো পরিস্থিতি বুঝে জীবনের শেষ মুহূর্তে তার শ্রেষ্ঠ ভাষণ দেয়ার প্রস্তুতি হিসেবে হুইস্কি পান করে।
যে কথার বিনিময়ে মুহূর্তেই জ্বলে উঠা শিখদের গুলিতে তার সাতাশ বছরের তরুণ দেহ রক্তে রঞ্জিত হয়ে যাবে।
সে হামলা থেকে আটকানোর উপায় ভাবতে ভাবতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ে।

সেদিন মাঝরাতে গুরুদুয়ারায় জুগগাত সিংয়ের দেখা মিলে।

সে মিত সিংয়ের কাছে ধর্মের বাণী শুনে ইকবালের ঘুমন্ত মুখ চেয়ে উঠে দাঁড়ায়।

একটা ট্রেনের লাইনের কয়েক ফুট উঁচুতে দড়ি বেঁধে ঝাঁকুনি দিয়ে ছাদের কয়েকশ মানুষকে মেরে ফেলার পাশাপাশি রেললাইনের পাশে বর্শা, শাবল, গুলি দিয়ে ট্রেনের মানুষকে মেরে ফেলার পরিকল্পনায় একা জুগগাত সিং সে রাতে কি করবে?

সে কি তার প্রেমিকা কিংবা ট্রেনের হাজার খানেক মানুষকে বাঁচাতে পারবে?
নাকি তারাও শতদ্রু নদীর জলে পড়ে নদীর বুকে কম্পন সৃষ্টি করবে!
আরেকটা লাশবাহী ট্রেন কিসের প্রতীক হিসেবে লাহোরে প্রবেশ করবে?

শান্তির নাকি সহিংসতার!

জানতে হলে পড়ুন দুর্দান্ত এই উপন্যাসটি।

About Labonya Roy

Check Also

কবিতাঃ সোনার বাংলা

 সোনার বাংলা লেখকঃ ফাতেমা তুজ জোহুরা যুদ্ধ শেষে স্বপ্ন দেখছি সোনার বাংলা গড়ার, আমরা চলেছি …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *