গ্রন্থের নামঃ বিলেতে সাড়ে সাতশ দিন ধরণঃ ভ্রমণকাহিনী প্রকাশঃ ১৯৫৮। |
চলুন ভ্রমণকাহিনীটি একনজরে পড়ে নেওয়া যাক:
আজ অর্থ থাকলেই পুরো বিশ্ব ঘুরে দেখা যায়। ঘরে বসেও বিশ্বকে জানা যাচ্ছে। কিন্তু গত শতকের মাঝামাঝি এমন ছিল না।
এমনি সময়ে অর্থাৎ ১৯৫০ সালের দিকে বিলেতে (ইংল্যান্ড) পড়ার ও ভ্রমণের স্মৃতি নিয়ে মুহাম্মদ আব্দুল হাই রচনা করলেন ‘বিলেতে সাড়ে সাতশ দিন’ যা ভ্রমনকাহিনী হিসেবে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল।
বইটির একত্রিশটি পরিচ্ছদে তৎকালীন সময়ের লন্ডন শহরের নানা গুরুত্বপূর্ণ দিক লেখক অত্যন্ত প্রাঞ্জল ভাষায় তুলে ধরেছেন।
সারবস্তু
“পাখির মতো ডানা মেলে দিয়ে জীবনে প্রথম আজ নিজের দেশের আকাশে উড়ছি। নিজের দেশের শ্যামা-শোভা এমন করে দেখার সুযোগ হয়নি কখনো। “
এভাবেই লেখক লন্ডন শহরের পাশাপাশি অন্যান্য যে শহরগুলোর সৌন্দর্য দেখেছিলেন তার এক নিখুঁত বর্ণনা তুলে ধরেছেন।
ঢাকা-কোলকাতা-দিল্লী-করাচী-বাগদাদ-কায়রো-জার্মানি হয়ে লন্ডন পৌছানোর পূর্ব পর্যন্ত প্রতিটি এলাকার বর্ণনা দিয়েছেন। করাচী বিমানবন্দর নামার পর লেখক বলেছেন,”প্রাচ্যে প্রবেশ করার রাজতোরণ এই করাচী।”
মধ্যপ্রাচ্যকে এক শুষ্ক অঞ্চল হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
লন্ডন শহর
১৯৫০ সালের ২১ সেপ্টেম্বর লেখক লন্ডন পৌঁছান। লন্ডনে পৌছানোর পর যে তীব্র শীতের মুখোমুখি হয়েছিলেন তার বর্ণনা দিয়েছেন। শীতকে জেনারেল উইন্টার হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
লেখকের বর্ণনায় লন্ডন শহর প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে।
লেখক বলেছেন, “ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর ছিল কোলকাতা। এরকম গোটা কয়েক কোলকাতা লন্ডন এর পেটে হজম হয়ে যাবে।”
লেখক লক্ষ্য করেছেন শীতের দেশ হওয়ায় বাড়িঘরগুলোতে বারান্দা নেই। কাচের পুরু জানালাগুলো কালেভদ্রে খোলা হয়। তবে প্রতিটি ঘরেই আছে কক্ষ গরম রাখার সুব্যবস্থা। শহরের রাস্তাঘাট তৈরিতে পরিকল্পনার ছাপ লক্ষণীয়। শহরের মাঝে মাঝে ছোট ছোট সবুজ পার্ক রয়েছে। এগুলোকে লেখক শহরের সমুদ্রসম প্রাসাদের মাঝে ছোট ছোট সুন্দর দ্বীপ বলে উপমা দিয়েছেন।
লন্ডনের ‘Natural History Museum’ মানুষকে মুগ্ধ করে দেবার মতো বলে উল্লেখ করেছেন লেখক। পাশাপাশি ব্রিটিশ মিউজিয়াম, মাদাম তুসো মিউজিয়াম এর কথা বলেছেন।
পারি, ফ্রান্স
লেখক পড়াশোনার অবসরে পারি শহর ঘুরেছেন। ইংল্যান্ড এর তুলনায় ফ্রান্সকে একটি পশ্চাৎপদ দেশ হিসেবে লক্ষ্য করেছেন তিনি।
উৎসব
বড়দিন প্রধান উৎসব। বড়দিন বা Christmas Day যীশু খ্রিস্টের জন্মদিন উপলক্ষে আয়োজন করা হয়।
লেখক বলেছেন, “একটা গোটা জাত যীশুর নামে কিভাবে সহজে আনন্দে ভেসে যায় ২৪শে ডিসেম্বর রাতে ইংরেজ নর-নারীর এই উদ্দাম নাচ-গান না দেখলে বোঝা যায় না। বড়দিনে ভোজের প্রধান অংশ রোস্ট, টার্কি, ক্রিসমাস পুডিং আর ক্রিসমাস কেক। টার্কি ছাড়া বড়দিনের ভোজ এদের জমেই না।
দিনের বেলা দুপুরেই এদের Christmas Dinner হয়।
Happy New Year
৩১ ডিসেম্বর ইংরেজ জাতের নাচের দিন। নেচে নেচে, হেসে খেলে এরা পুরাতন বছরকে বিদায় দেয়।
স্বদেশপ্রেম
প্রবাস জীবনে লেখক তার মাতৃভূমির প্রতি পরম মমতা অনুভব করেছেন। লেখক পরতে পরতে বাংলার সবুজ শ্যামল প্রকৃতিকে স্মরণ করেছেন। যদিও অশিক্ষিত ও পরচর্চায় লিপ্ত স্বদেশবাসীর প্রতি তার নেতিবাচক মনোভাব স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
লেখক ইংল্যান্ডেকে একটি নিশ্চুপ, পরিশ্রমী ও সাহসী জাতি হিসেবে তুলে ধরেছেন, যেখানে তার দেশবাসী কুশলতায় সিদ্ধহস্ত কিন্তু অলস।
বাড়ি ফেরার পূর্বে
ভ্রমণকাহিনীর শেষ পরিচ্ছেদে বিদেশে প্রিয়জনের জন্য তার মনের হাহাকার ও ব্যাকুলতার কথা বলেছেন। স্বদেশের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয়গুলো তার মনের জায়গা দখল করে থাকে। তবে স্বদেশ ও পরিবারের প্রতি মমত্ববোধ এবং লন্ডনের প্রবাস জীবনের স্মৃতির বহর ফেরার সময় লেখকের মনে এক প্যারডক্সের জন্ম দেয়।
লেখক বলেছেন,
“অদ্ভুত মানুষের জীবন। এক পায় তো আর চায়। এর জন্যই বোধহয় বাংলার কবি বলেছিলেন –
“যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই
যাহা পাই তাহা চাই না’।”
মুহাম্মদ আব্দুল হাই রচিত ‘বিলতে সাড়ে সাতশ দিন’ গ্রন্থটি সম্পর্কে আবদুল গাফফার চৌধুরী অভিমত ব্যক্ত করে বলেছেন,
“ভ্রমণ নয়- স্মৃতিকথা, স্মৃতিকথা নয়- ভ্রমণ। এই দুইয়ের সংমিশ্রণে এক আশ্চর্য রস সৃষ্টি করেছেন তিনি; তাতে সংগীতের সম্মোহ সৃষ্টি করেছে ভাষা।”
পরিশেষে এই কথাটি নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, ১৯৫০ সালের দিকে বহির্বিশ্বের ছবি বা কাহিনী নিয়ে বাংলা ভাষায় যে কয়টি বই রচিত হয় তার মধ্যে এই বইটি এক বিশেষ স্থান দখল করে আছে।