পালামৌ- বাংলা সাহিত্যের প্রথম সফল ভ্রমণকাহিনী।
লেখাটি লেখক উনিশ শতকের শেষার্ধে লিখেছেন। ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায় যে তার ভ্রমণকাহিনীর ছয় খন্ড ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল সেটাও তিনি লেখার ফাঁকে সুকৌশলে বর্ণনা করেছেন।
যদিও লেখক ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হওয়ার ফলে তার চাকরির সুবাদেই সেখানে গিয়েছিলেন।
প্রথমে লেখার ভূমিকাটুকু পড়লেই ভিতরের লেখা সম্পর্কে বেশ ভালো একটা ধারণা পাওয়া যাবে। সেসময়ে এরকম ভ্রমণকাহিনী যেহেতু আর লেখা হয়নি, তাই ভ্রমণকাহিনীর বাইরেও লেখকের পর্যবেক্ষণকৃত কিছু জিনিস স্থান পেয়েছে।
কিছু জায়গায় সাধুভাষার প্রয়োগে কিছু জিনিস বুঝতে কয়েকবার পড়তে হয়েছে।
পিঁয়াজ এর পরিবর্তে তিনি ‘পলান্ডু’ নিয়ে হাস্যরসিকতার মাধ্যমে এক জমিদারের কাহিনী অবতীর্ণ করেছেন। কলার পরিবর্তে ‘রম্ভা’ লিখে পরক্ষণেই আবার সেটা অন্যভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন।
তিনি পালামৌ-এ বসবাসরত কোল নরনারীদের জীবিকা, আসুরিক বিবাহ, গরুর পরিবর্তে মহিষ পালন, মহুয়া ফুলের উপকারিতা, বাঘ শিকার, লাতেহার পাহাড় প্রভৃতির কথা যেমন তুলে ধরেছেন; ঠিক তেমনিভাবে পাহাড়ের উপর বেড়ে উঠা অশ্বত্থ গাছ নিয়েও গভীর চিন্তা দ্বারা মতামত প্রকাশ করেছেন।
রবি ঠাকুর তার লেখার প্রশংসার সাথে হালকাভাবে সমালোচনাও করেছেন। সেটা পড়লে অনেকাংশে আমার অনুর্বর মস্তিষ্কও সেটাই সমর্থন করবে।
‘বাল্যকালে আমার মনে হইত যে ভূত-প্রেত যে প্রকার নিজে দেহহীন, অন্যের দেহ-আবির্ভাবে বিকাশ পায়, রুপও সেইপ্রকার অন্য দেহ অবলম্বন করিয়া প্রকাশ পায়; কিন্তু প্রভেদ এই যে, ভূতের আশ্রয় কেবল মনুষ্য, বিশেষত মানবী। কিন্তু বৃক্ষ, পল্লব, নদ ও নদী প্রভৃতি সকলেই রুপ আশ্রয় করে। সুতরাং রুপ এক, তবে পাত্রভেদ।’
সঞ্জীববাবুর সৌন্দর্য্যতত্ত্ব ভালো করিয়া না বুঝিলে তাহার লেখাও ভালো করিয়া বুঝা যায় না, ভালো করিয়া সম্ভোগও করা যায় না।
বন্যেরা বন্যে সুন্দর; শিশুরা মাতৃক্রোড়ে।
তবে অন্য অর্থ দিয়ে তিনি ভিন্নার্থই বুঝিয়েছেন। আমার মনে হয়, কথাটায় একটা ডাবল স্টান্ডার্ড আছে।’
‘পাহাড়, জঙ্গল, বাঘ, এই লইয়াই পালামৌ। যেসকল ব্যক্তি তথায় বাস করে, তাহারা জঙ্গলী, কুৎসিত, কদাকার জানোয়ার, তাহাদের পরিচয় লেখা বৃথা।’
তিনি ২য় খন্ডে কুৎসিত, রুপবানের পার্থক্যের ফারাকটা পরে এসে যেন পরিষ্কার করে দিলেন। অথচ তিনি লেখার বেশিরভাগই কোলদের নিয়ে করেছেন।
তাকে খাঁ সাহেব’ বলে একজন অপিরিচিত সম্বোধন করায় তিনি তাকে হারামজাদা বলে গালি দিয়েছেন। কারণ, সেটা দাস মশায় বা বোস মশায় অপেক্ষা বেশি পদমর্যাদার নয়। সেখানে ‘খাঁ বাহাদুর’ বলে সম্বোধন করলেও তিনি সহ্য করতে পারতেন।
আর সেই ক্ষোভেই তিনি তাদের সাহায্য না করে বরং তাড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি যে রমণীর ভ্রু-যুগল পাখির ডানার সাথে তুলনা করেছেন। সেই রমনীই তার কাছে শূণ্যহাতে ফিরে গিয়ে বনের পথেই মারা গিয়েছে। এটা শুনে লেখকের কষ্ট হয়েছে।
এত কিছু বর্ণনার একটাই কারণ; আমাদের সুপরিচিত, সুবিখ্যাত সেই উক্তিটিতে ফিরে যাওয়া।
আমি যদি তার মতের আলোকে না ধরি, তাহলে হয়তো কথাটা যুক্তিযুক্ত। একটু মারপ্যাঁচ লাগালেও পুরো বই পড়ে আমার মনে হয়েছে- সৌন্দর্য্যবোধ নিয়ে তার উচ্চমার্গীয় ধারণা থাকলেও তিনি নেতিবাচকভাবেই কথাটা লিখেছেন।
কিন্তু বিশ্লেষন অংশটুকু বাদ দিয়ে যদি আমি ”বন্যেরা বন্যে সুন্দর; শিশুরা মাতৃক্রোড়ে” শুধু এই কথাটুকুই ধরি তাহলে হয়তো আর এতটা জট পাকিয়ে উঠে না। এই লেখা ধরেই আমরা তুমুল বিশ্লেষণ করে, ভাবসম্প্রসারণ করে খাতার পাতা ভরিয়ে ফেলতে পারি।
অথচ মুদ্রার ওপিঠও তো আছে। হেরে গেলেই তো রাগ হওয়াটাই স্বাভাবিক, তাইনা!
এই বইটা পড়লে প্রকৃতিপ্রেমীরা আলাদা একটা সৌন্দর্য্যের সান্নিধ্য পাবে।