পালামৌ: রোমাঞ্চে ভরা এক ভ্রমণকাহিনী

#বন্যেরা বন্যে সুন্দর;
শিশুরা মাতৃক্রোড়ে’

পালামৌ- বাংলা সাহিত্যের প্রথম সফল ভ্রমণকাহিনী।

বইটি পড়ার সুবাদে এই তথ্যের পাশাপাশি জানতে পারলাম, বইয়ের লেখক সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়; বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর বড় ভাই। কিছু কিছু জিনিস জানতে পারলে নিজের মধ্যে একটা ভালো লাগা কাজ করে। এই প্রসঙ্গে আমারও ঠিক সেরকম হল।

লেখাটি লেখক উনিশ শতকের শেষার্ধে লিখেছেন। ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায় যে তার ভ্রমণকাহিনীর ছয় খন্ড ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল সেটাও তিনি লেখার ফাঁকে সুকৌশলে বর্ণনা করেছেন।

প্রথমে পড়ার সময় মনে হতে পারে, লেখক ভ্রমণ করার জন্যই ঝাড়খন্ডের সেই পাহাড় ঘেরা বন-জঙ্গলে গিয়েছিলেন।

যদিও লেখক ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হওয়ার ফলে তার চাকরির সুবাদেই সেখানে গিয়েছিলেন।

প্রথমে লেখার ভূমিকাটুকু পড়লেই ভিতরের লেখা সম্পর্কে বেশ ভালো একটা ধারণা পাওয়া যাবে। সেসময়ে এরকম ভ্রমণকাহিনী যেহেতু আর লেখা হয়নি, তাই ভ্রমণকাহিনীর বাইরেও লেখকের পর্যবেক্ষণকৃত কিছু জিনিস স্থান পেয়েছে।

যেমন তিনি বলেছেন, বাঙালি মাত্রই সজ্জন, কিন্তু বাঙালিদের প্রতিবেশী মাত্রই দূরাত্মা, নিন্দনীয়। কিন্তু প্রত্যেক বাঙালীই কারোর না কারোর প্রতিবেশী, তাই প্রকৃতপক্ষে কোন বাঙালীই সেই অর্থে সজ্জন নয় এরকম মনোভাবই বাঙালীদের মধ্যে প্রচলিত।

কিছু জায়গায় সাধুভাষার প্রয়োগে কিছু জিনিস বুঝতে কয়েকবার পড়তে হয়েছে।

পিঁয়াজ এর পরিবর্তে তিনি ‘পলান্ডু’ নিয়ে হাস্যরসিকতার মাধ্যমে এক জমিদারের কাহিনী অবতীর্ণ করেছেন। কলার পরিবর্তে ‘রম্ভা’ লিখে পরক্ষণেই আবার সেটা অন্যভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন।

সাতনরী যে গলার মালা, আর ধুকধুকি বলতে যে ‘লকেট’ বোঝায়; সেটা কোল রমণীদের বর্ণনায় না থাকলে জানতাম না।

তিনি পালামৌ-এ বসবাসরত কোল নরনারীদের জীবিকা, আসুরিক বিবাহ, গরুর পরিবর্তে মহিষ পালন, মহুয়া ফুলের উপকারিতা, বাঘ শিকার, লাতেহার পাহাড় প্রভৃতির কথা যেমন তুলে ধরেছেন; ঠিক তেমনিভাবে পাহাড়ের উপর বেড়ে উঠা অশ্বত্থ গাছ নিয়েও গভীর চিন্তা দ্বারা মতামত প্রকাশ করেছেন।

রবি ঠাকুর তার লেখার প্রশংসার সাথে হালকাভাবে সমালোচনাও করেছেন। সেটা পড়লে অনেকাংশে আমার অনুর্বর মস্তিষ্কও সেটাই সমর্থন করবে।

তবুও লেখকের সৌন্দর্য্যবোধ অতি চমৎকার বলেই মনে হয়েছে। তিনি লিখেছেন-

‘বাল্যকালে আমার মনে হইত যে ভূত-প্রেত যে প্রকার নিজে দেহহীন, অন্যের দেহ-আবির্ভাবে বিকাশ পায়, রুপও সেইপ্রকার অন্য দেহ অবলম্বন করিয়া প্রকাশ পায়; কিন্তু প্রভেদ এই যে, ভূতের আশ্রয় কেবল মনুষ্য, বিশেষত মানবী। কিন্তু বৃক্ষ, পল্লব, নদ ও নদী প্রভৃতি সকলেই রুপ আশ্রয় করে। সুতরাং রুপ এক, তবে পাত্রভেদ।’

চন্দ্রনাথবাবু নামক ভদ্রলোক এই প্রসঙ্গে লিখেছেন-

সঞ্জীববাবুর সৌন্দর্য্যতত্ত্ব ভালো করিয়া না বুঝিলে তাহার লেখাও ভালো করিয়া বুঝা যায় না, ভালো করিয়া সম্ভোগও করা যায় না।

কিন্তু তার ‘কোল’ জাতি নিয়ে ২য় খন্ডের বর্ণনায় দেখা যায়-
কোলেরা বন্য জাতি, খর্বাকৃতি, কৃষ্ণবর্ণ; দেখিতে কুৎসিত কিংবা রুপবাণ তাহা আমি মীমাংসা করিতে পারি না! যে-সকল কোল কলিকাতা আইসে বা চা-বাগানে যায় তাহাদের মধ্যে আমি কাহাকেও রুপবান দেখি নাই; বরং কুৎসিত বলিয়া বোধ করিয়াছি।
কিন্তু স্বদেশে কোলমাত্রেই রুপবান, অন্তত আমার চক্ষে।

বন্যেরা বন্যে সুন্দর; শিশুরা মাতৃক্রোড়ে।

আমার বন্ধুমহাশয় বুদ্ধিমান মানুষ। এটা নিয়ে তার মন্তব্য সে সুন্দরভাবে প্রকাশ করেছে। তার মতে-
‘তিনি যদি এখানে রুপবান, কুৎসিত এগুলো দ্বারা রুপ ভিন্ন অন্য কিছু বোঝাতেন; তাহলে একটা বিষয় ছিল। তিনি তাদের কুৎসিত ধরে নিয়েই বুঝিয়েছিলেন যে, এই কুৎসিতদের বনেই মানায়; কলকাতায় না।

তবে অন্য অর্থ দিয়ে তিনি ভিন্নার্থই বুঝিয়েছেন। আমার মনে হয়, কথাটায় একটা ডাবল স্টান্ডার্ড আছে।’

আমি তখনও ওই অংশটুকুতে পড়েই ভাবছি। তারপর চতুর্থ খন্ডের শুরুতে এসে আবার যখন তিনি বলেছেন-

‘পাহাড়, জঙ্গল, বাঘ, এই লইয়াই পালামৌ। যেসকল ব্যক্তি তথায় বাস করে, তাহারা জঙ্গলী, কুৎসিত, কদাকার জানোয়ার, তাহাদের পরিচয় লেখা বৃথা।’

তিনি ২য় খন্ডে কুৎসিত, রুপবানের পার্থক্যের ফারাকটা পরে এসে যেন পরিষ্কার করে দিলেন। অথচ তিনি লেখার বেশিরভাগই কোলদের নিয়ে করেছেন।

রুপ নিয়ে পরক্ষণেই তিনি আবার লিখেছেন, আমি কখনো অঙ্গ বাছিয়া রুপ তল্লাশি করি নাই।
কিন্তু রুপ নিয়ে বাছবিছার, আত্মগরিমা আর অহঙ্কারের প্রচন্ড প্রতাপ যে তার ছিল, সেটা আরও একটা ঘটনায় দেখা যায়।

তাকে খাঁ সাহেব’ বলে একজন অপিরিচিত সম্বোধন করায় তিনি তাকে হারামজাদা বলে গালি দিয়েছেন। কারণ, সেটা দাস মশায় বা বোস মশায় অপেক্ষা বেশি পদমর্যাদার নয়। সেখানে ‘খাঁ বাহাদুর’ বলে সম্বোধন করলেও তিনি সহ্য করতে পারতেন।

আর সেই ক্ষোভেই তিনি তাদের সাহায্য না করে বরং তাড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি যে রমণীর ভ্রু-যুগল পাখির ডানার সাথে তুলনা করেছেন। সেই রমনীই তার কাছে শূণ্যহাতে ফিরে গিয়ে বনের পথেই মারা গিয়েছে। এটা শুনে লেখকের কষ্ট হয়েছে।

কিন্তু জীবনের শেষপর্যায়ে পালামৌ নিয়ে লিখতে এসে লেখক অনুশোচনার বদলে উল্লেখ করেছেন-
তখন জানিতাম না যে, একদিন আপনার অহঙ্কারে আপনি হাসিব।

এত কিছু বর্ণনার একটাই কারণ; আমাদের সুপরিচিত, সুবিখ্যাত সেই উক্তিটিতে ফিরে যাওয়া।

আমি যদি তার মতের আলোকে না ধরি, তাহলে হয়তো কথাটা যুক্তিযুক্ত। একটু মারপ্যাঁচ লাগালেও পুরো বই পড়ে আমার মনে হয়েছে- সৌন্দর্য্যবোধ নিয়ে তার উচ্চমার্গীয় ধারণা থাকলেও তিনি নেতিবাচকভাবেই কথাটা লিখেছেন।

কিন্তু বিশ্লেষন অংশটুকু বাদ দিয়ে যদি আমি ”বন্যেরা বন্যে সুন্দর; শিশুরা মাতৃক্রোড়ে” শুধু এই কথাটুকুই ধরি তাহলে হয়তো আর এতটা জট পাকিয়ে উঠে না। এই লেখা ধরেই আমরা তুমুল বিশ্লেষণ করে, ভাবসম্প্রসারণ করে খাতার পাতা ভরিয়ে ফেলতে পারি।

পরিশেষে লেখকের কথা ধরেই লিখি, সে সকল রাগের কথা থাক; যে হারে, সেই রাগে।
কিন্তু আমরা বলি, রেগে গেলেন তো হেরে গেলেন।

অথচ মুদ্রার ওপিঠও তো আছে। হেরে গেলেই তো রাগ হওয়াটাই স্বাভাবিক, তাইনা!

বই পড়ে রাগ হয় না, হেরে যাওয়ার সম্ভাবনাও নেই। বরং চিন্তাভাবনা বিকশিত হওয়ার সাথে ভালো সময় কাটানোর সুযোগ আছে।

এই বইটা পড়লে প্রকৃতিপ্রেমীরা আলাদা একটা সৌন্দর্য্যের সান্নিধ্য পাবে।

তাই বই পড়ি, সেইসাথে এই ভ্রমণকাহিনী পড়ুয়া ব্যক্তিরা একটু মতও প্রকাশ করি।

About Labonya Roy

Check Also

কবিতাঃ সোনার বাংলা

 সোনার বাংলা লেখকঃ ফাতেমা তুজ জোহুরা যুদ্ধ শেষে স্বপ্ন দেখছি সোনার বাংলা গড়ার, আমরা চলেছি …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *