ছবির দেশে কবিতার দেশেঃ ফরাসি সভ্যতা, শিল্প ও সাহিত্যের এক মেলদর্শন

ছবির দেশে কবিতার দেশে। উৎসঃ https://www.bondhushava.com/writings/z17lkazh8e
ছবির দেশে কবিতার দেশে- যে বই পড়ে জীবনে একবার হলেও আমার প্যারিসে যেতে ইচ্ছে করে।
আলোর দিকে তাকাও, ভোগ করো এর রূপ। চক্ষু বোজো এবং আবার দ্যাখো। প্রথমেই তুমি যা দেখেছিলে, তা আর নেই। এরপর তুমি যা দেখবে, তা এখনো হয়ে ওঠেনি।

—-লিওনার্দো দা ভিঞ্চি।

ভিঞ্চি কবিতা ও লিখেছিলেন! এটাও আশ্চর্যজনক কিছু নয়। একজন শিল্পীকে দিয়েই একটা দেশ চেনা গেলে প্রথমে হয়তো ভিঞ্চির নামটাই প্রথমে আসবে। অথচ তিনি ফ্রান্সের অধিবাসী নন, ইতালির।

শিল্প-সাহিত্যে সমৃদ্ধ একটা দেশকে যদি প্রথম সারির দিকে রাখা যায়, সেটা ফ্রান্স।

সেই আইফেল টাওয়ারের (ফরাসি-তুর দেফেল) দেশের সাতাশ বছরের তরুণী, যে কবিতা ভালোবাসে, শিল্পের প্রতি যার দারুণ ঝোঁক, সুন্দর, হাসিখুশি সোনালী রঙের ঝাঁকড়া চুলের ফরাসি সাহিত্যে পড়াশোনা করা মার্গারিট ম্যাতিউ।

অন্যদিকে ফরিদপুরে জন্ম নেয়া, কলকাতায় মতো শহরে বেড়ে ওঠা, কফি হাউজের আড্ডাপ্রিয়, ভ্রমণপ্রিয়, কৃত্তিবাস পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক, ত্রিশ বছর বয়সী কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।

তাদের দেখা হওয়ার কথা ছিল ফ্রান্সে, নাহলে কলকাতায়। অথচ তাদের দেখা হলো মধ্য আমেরিকার ছোটখাটো একটা জায়গায়, যেখানে একটা বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরে পুরো শহর গড়ে উঠেছে। আয়ওয়া বিশ্ববিদ্যালয়। যে শহরে রবীন্দ্রনাথের পদধূলি পড়েছে তারও অনেক আগে।

সুনীলের সাথে মার্গারিটের দেখা হওয়াটার মধ্যেই চমৎকারিত্ব লুকিয়ে রয়েছে। দুজনের মধ্যে যোগবন্ধনের মাধ্যমই ছিল শিল্প আর সাহিত্য। কবিতা ছিল যার প্রাণ।

আয়ওয়া’র ইংরেজি বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা, পল এঙ্গেল, যিনি কলকাতায় অনেকবার ঘুরতে এসেছেন, সেই অধ্যাপকের আকস্মিক ডাকে লেখক ক্রিয়েটিভ রাইটিং প্রোগ্রামে যোগদানের উদ্দেশ্যে এক বছরের জন্য আয়ওয়া’তে যান।
মার্গারিট তখন আয়ওয়া’তে পি.এইচ.ডি করার পাশাপাশি ফরাসি সাহিত্যের শিক্ষিকা।

একটা বছর হয়তো কারো জন্য অনেক কম সময়, কারো জন্য দীর্ঘ। এই এক বছরেই মার্গারিটের সাহচর্যে বিদেশে একা, নিঃসঙ্গ কবি, ফরাসি শিল্প-সাহিত্যের প্রতি আরও বিশেষভাবে আকৃষ্ট হন।

এমনকি মার্গারিটের ইউরোপীয় প্রেমগাঁথার কাহিনি শুনে ত্রিস্তান-ইসল্ট নিয়ে তার প্রথম পূর্ণাঙ্গ গদ্য `সোনালী দুঃখ’ রচনা করেছিলেন।

বইয়ের প্রতিটা অনুচ্ছদের শুরুতে ফ্রান্সের বিখ্যাত কবি-সাহিত্যিকদের কবিতার লাইন দেয়া। মার্গারিটের সবচেয়ে পছন্দের ছিল রেনেসার, শার্ল বোদলেয়ার, গীয়ম অ্যাপোলিনিয়ারের মতো কবি।

প্রতিটা অনুচ্ছেদে লেখকের ভ্রমণকাহিনীর পাশাপাশি উল্লেখ আছে দেগা, এদুয়ার মানে, ক্লোদ মোনে, গগ্যাঁ, মাতিস, রুয়ো, কামিল পিসারো, রেনোয়া,পাবলো পিকাসোর মতো বিখ্যাত সব শিল্পীদের টুকরো জীবনের কাহিনি।
যাদের অনেকেই ইমপ্রেশানিজম আন্দোলনের উদ্যোক্তা ছিলেন।

আছে জাঁ পল সাত্র, রুশো, ভলতেয়ার, র্যাবো,ভালেরি, আরি মিসো, এমিল জোলা, বোদলেয়ারের মতো বিখ্যাত সব কবিদের জানা-অজানা সব তথ্য।

বার্নার্ড শ’ নাকি চলন্ত বাসে নোট বইতে নাটকের সংলাপ লিখে রাখতেন। ভিক্টর হুগো প্রায়শই প্ল্যানচ্যাট করতেন। গোয়েন্দাকাহিনির স্রষ্টা জর্জ সিমেনো টানা চৌদ্দ-পনেরোদিনে দরজা বন্ধ করে রাত-দিন লিখে এক একটা বই শেষ করতেন।

বিখ্যাত সিগমুন্ড ফ্রয়েড ভিয়েনা থেকে এক সেমিনারে যোগ দিতে প্যারিসে আসেন, ফরাসি ভাষা রপ্ত না থাকার দরুন সেমিনারে যোগ না দিয়ে তিনি ফিরে যান ভিয়েনাতে। দু’বছর বাদে ফরাসি রপ্ত করে তিনি প্যারিসে এসেছিলেন।

এসব কবিতা, শিল্পের ফাঁকে ফাঁকে আছে ফ্রান্সের নর্মান্ডিতে জার্মানির পরাজয়ের রহস্য, ফরাসী আঠারো বছরের সাহসী তরুণী জোয়ান আর্কের কাহিনি।

জর্ডান নদীর পানি ছিটিয়ে দা ব্যাপটিস্টের যীশু খ্রিষ্টকে দীক্ষা করার মন্ত্র; আছে নীল নাকি নাইল, নদ নাকি নদী হওয়ার দ্বন্দ্ব।

রুশো আর ভলতেয়ারের দা-কুমড়া সম্পর্ক থেকে লেখা গড়িয়েছে বাঙালি দুই সাহিত্যিক বিদ্যাসাগর আর বঙ্কিমচন্দ্রের দ্বন্দ্বের দিকে। লেখকের লেখা থামে নি, বরং প্রতি অনুচ্ছেদেই নতুনভাবে বাঁক নিয়েছে।

সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ কবিতার নিউইয়র্কবাসী বিখ্যাত কবি- অ্যালেন গীনসবার্গ ছিলেন কবির বন্ধু। আমেরিকা থেকে ফেরার সময় কবি তার বন্ধুর নিবাসে কিছুদিন আশ্রয়গ্রহণ করেছিলেন।

কেউ একজন বলেছিল, প্রত্যেক শিল্পীরই দুটি মাতৃভূমি, একটি, যেখানে সে জন্মেছে, অন্যটি ফ্রান্স।

১৯৬৪- সালের দিকে লেখক প্রথমবার মার্গারিট সহ পুরো একমাস ধরে প্যারিস ভ্রমণ করেছিলেন। ঘুরেছেন ল্যুভর মিউজিয়াম থেকে শুরু করে আর্ট গ্যালরী, রেস্তোরাঁ, প্যারিসের অলি-গলি; স্যেন নদীর ধার ঘেঁষে দুজনে হেঁটে বেড়িয়েছেন।
এরপর লেখক ফ্রান্স গিয়েছেন আরও কয়েকবার। কিন্তু মার্গারিটের রহস্যময় হারিয়ে যাওয়া যেন লেখকের পাশাপাশি পাঠকের মনকেও গভীরভাবে ব্যথিত করে তোলে।

প্রতিটা লেখার মধ্যে কারো ছোঁয়া আছে, অথচ সে নেই।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছেন- `হঠাৎ কোনো গাড়ির আড়াল থেকে মার্গারিট এসে আমার সামনে দাঁড়ালো, মেঘলা রাতের জ্যোৎস্নার মতো হাসলো, পৃথিবীতে এমন মিরাকল কি ঘটতে পারে না?’

হয়তো মিরাকল ঘটতে পারে। কিন্তু এখানে ঘটে নি। কুড়ি বছর পরেও তিনি ফ্রান্সের সেই লুদা গ্রামে মার্গারিটকে আনমনে খুঁজে বেড়িয়েছেন। আয়ওয়ার সেই ছোট্ট নদীর ধার দিয়ে হেঁটে স্মৃতি হাতড়িয়েছেন।

লেখক সারাবিশ্বের অনেক দেশ ঘুরেছেন; অনেক জায়গার বর্ণনা দিয়েছেন; অনেক অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেছেন। কিন্তু যেকোনো দেশে যাওয়ার পথে তার ফ্রান্সের প্রতি আত্মার টান দমিয়ে রাখতে পারেন নি।

রেনোয়া বলেছিলেন, সব যন্ত্রনাই এক সময় শেষ হয়ে যায়, কিন্তু শিল্প থাকে।

সেই শিল্প হয়ে উঠেছে মার্গারিট। কোনো শিল্পীর তুলির আঁচড়ে নয়, বরং সুনীলের কলমের ডগায় অনুভূতির মিশ্রনে লেখা স্মৃতির পাতায়।

About Labonya Roy

Check Also

Teeth of Fishes

Living Agnathan fishes possess conical, rasping tooth-like structures made of keratin, the same structural protein …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *